এখনও অনেক কষ্ট করে সংসার চলে;বীরঙ্গনা টেপরি বেওয়া

656
এখনও অনেক কষ্ট করে সংসার চলে;বীরঙ্গনা টেপরি বেওয়া
এখনও অনেক কষ্ট করে সংসার চলে;বীরঙ্গনা টেপরি বেওয়া

হুমায়ুন কবির, রাণীশংকৈল(ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধিঃ ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলা বলিদ্বারা গ্রামের বীরঙ্গনা টেপরি বেওয়া (৬৫)। বাড়িতে ঢুকতেই মুখে মৃদু হাঁসি দিয়ে পরিচয় জানতে চাইলেন। এরপরে বসতে দিলেন দুইটি চেয়ার আর আমাদের পরিচয় পেয়ে কাছে এসে বললেন কি জানতে চান বলেন? ১৭ অক্টোবর শনিবার দুপুরে একান্ত সাক্ষাতকারে টেপরি বেওয়া তার নিজ বাড়িতে আলাপকালে জানান, “১৯৭১ সাল দেশে তখন ভয়াল স্বাধীনতা যুদ্ধ।

আমার বয়স তখন ১৬-১৭ এর মত হবে। প্রতিদিন বাবা ভাইয়ের সাথে ভয়ে ভয়ে কাটতো দিন। প্রতিদিনই মনে হতো এই বুঝি পাঞ্জাবিরা এসে তাদের মেরে ফেলবে। এপ্রিলের শেষদিকে টেপরির গ্রামের এক নেতৃস্থানীয় লোক তার বাবা ভাইকে বলে “যদি তোমরা তোমাদের এই মেয়েটাকে পাকিস্তানের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দাও তাইলে এই মেয়ের উছিলায় তোমার পুরো পরিবার বেঁচে যেতে পারে”। কোন উপায় না থাকায় সহজ সরল বাবা মেয়ের হাত ধরে কাছের পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্পে দিয়ে আসে আমাকে ।

সারা রাস্তা ধরে একটা কথা বলে নাই বাপ মেয়ে। টেপরিকে দিয়েই মাথা নিচু করে ফিরে আসে।এর পর সাত মাস টেপরি ছিল সেই পাক ক্যাম্পে। টেপরির কাছে প্রতিরাতেই আসতো তিন- চারজন পাকিস্তানি শুয়োরের বাচ্চারা। পালাকরে প্রতিদিনই পাষবিক নির্যাতন করতো তারা। আর বাকি অত্যাচারের কথা মুখে বলার নয়। এভাবেই দীর্ঘ সাত মাস নিজের দেহের বিনিময়ে নিজের পরিবার ও দেশকে রক্ষা করে টেপরি বেওয়া।এর মধ্যে সময় অতিবাহিত হওয়ার পর দেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তান ক্যাম্প থেকে টেপরির বাবা টেপরিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। টেপরি ততদিনে গর্ভবতী।গ্রামের লোকেরা টেপরি বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলতে বলে। কিন্তু টেপরির বাবা তাকে বলে রেখে দে মা, তোর তো আর কেউ রইবে না। এই বাচ্চাই তোর একমাত্র সম্বল হবে। শেষ বয়েসে তোর দেখা শুনার জন্য সেই তোকে আগলে রাখবে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এরই মধ্যে জন্ম হয় টেপরি বেওয়ার একমাত্র ছেলে। ছেলের নাম রাখা হয় সুধীর।ছোট থেকেই সুধীরের সাথে কেউ খেলতো না, তার থেকে সবাই দূরে দূরে থাকতো। এমন যে সুধীর মনে হয় কোন ছোয়াছে রোগ। তাকে সবসময় পাঞ্জাবির বাচ্চা জারজ বলে ডাকতো, আর অনেক অপমান করতো তাকে। কিন্তু সুধীর কিছুই বলতো না। বলার ভাষাও ছিল না তার জানা।কেন কোন প্রতিবাদ করতো না সুধীরকে জিজ্ঞেস করা হলে সুধীর বলেছিলো “ঝগড়া করতে তো লোক লাগে, কিন্তু আমার সাথে কেউ মিশতো না। জীবনটা এখনো তার ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

এভাবেই একাই জীবন কাটে ভ্যানচালক সুধীরের। সুধীরের পরিবারে সুধীর, তার মা, বউ,আর দুই মেয়ে এই সুধীরের পৃথিবী।গ্রামের আর কার সাথে তাদের সম্পর্ক তেমন নেই। সুধীরের ছোট মেয়ে জনতা রায়। সে দিনাজপুর কে.বি.এম কলেজ অনার্স ৩য় বর্ষে অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে তার দুই জমজ মেয়েকে সুধীর লালন পালন করে। এ নিয়ে টেপরি বেওয়াসহ ৬ সদস্যের ভরণপোষন কষ্ট করে চালিয়ে যাচ্ছে সুধীর। টেপরি বেওয়ার সরকারি বীরঙ্গনা ভাতা বাবদ ১২হাজার টাকা পেলেও ঋণের কিস্তি বাবদ অর্ধেক টাকা কেটে নেয়।

এরই মধ্যে জেলা প্রশাসকের দেয়া একটি অটো চার্জার সুধীরকে দেওয়া হলে সে এখন ভ্যান ছেড়ে অটো চালিয়ে সংসারের ঘানি টানতেও হিমশিম খায় বলে জানান টেপরি বেওয়া”। টেপরি বেওয়ার ছোট নাতনি জনতা রায় বলেন, “দাদির ভাতার টাকা বাবার অটো চালানোর টাকা দিয়ে ৬জনের পরিবারের ভরনপোষন ও আমার লেখাপড়ার খরচ চালাতে বাবার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। গত বছর ডিসি স্যার আমাদের বাড়িতে এসে আমার পড়া লেখার বিষয়ে খরচ দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তা এখনো আমি পাইনি। ”সংবাদ প্রতিবেদককে বীরাঙ্গনা টেপরি বেওয়া বলেন, শরীর তেমন আমার ভাল নেই, কোমড়ে সবসময় ব্যাথা লেগেই আছে। সুধীরের সংসার টানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এ করোনা কালে ছেলের আয় কমে গেছে। সবমিলে এখনো অনেক কষ্ট করে সংসার চলে!

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক প্রত্যাশা প্রতিদিন এর দায়ভার নেবে না।